খলিফা ওমর এবং বৃদ্ধ কবি - রুমির কবিতা ২৬

বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন কবি। 
তার কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসে এবং রূঢ়, 
তার বীণার কিছু তার ছিড়ে গেছে। 
যে কবিতা একসময় আত্মাকে সতেজ করতো
এখন তা আর কারো কাজে লাগে না, 
প্রেমের দেবী ভেনাস যে সুরের আরাধনা করতো 
এখন সেই সুর বৃদ্ধ গাধার ডাকের মতো অসহ্য।
একসময় বাজপাখি যা শিকার করতো 
এখন তা ছাগলও শিকার করতে পারে। 
সব সুন্দর জিনিস ধ্বংস হয়ে গেছে
আমরা যে পথে হেঁটে চলেছি
সেই পথে কি কোনো ছাদ ভেঙে পড়েনি?
শুধু বুকের মধ্যে যে অন্তঃস্বর শোনা যায়  
তা কখনো ম্লান হয় না। 
কেবলমাত্র এম্বারই ক্রমাগত স্থির শক্তির সাথে 
সমস্ত চিন্তাভাবনা এবং প্রতিটি শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কবি দিনদিন দুর্বল এবং গরীব হয়ে পড়েছেন 
কারণ তার কবিতা আর কেউ শুনতে চায় না। 

তিনি মদিনার কবরস্থানে গিয়ে প্রার্থনা করেন, 
‘প্রভু, তুমি তো সর্বদা আমার কাছ থেকে 
অচল মুদ্রা গ্রহণ করেছো! 
এবার আমার এই প্রার্থনা গ্রহণ করে নাও 
আমাকে আমার বীণার জন্য 
নতুন রেশম তার কেনার যথেষ্ট অর্থ দাও।’
বীণায় যে কয়টি তার ছিলো 
তাই দিয়েই তিনি কয়েকটি লাইন গাইলেন, 
‘সত্তর বছর ধরে আমি তোমাকে ভুলে গেছি, 
কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও 
তোমার রহমতের প্রবাহ মন্থর কিংবা বন্ধ হয়ে যায়নি। 
আমি কিছুই পাওয়ার যোগ্য নই। 
আধ্যাত্মিক মানুষেরা যে অতিথির কথা বলে
আমি হলাম সেই অতিথি।
আমি এই প্রাণবন্ত গান গাই তোমার জন্য 
আজকের সবকিছুই মূলত তোমার।’
তিনি যন্ত্রটি পাশে রেখে 
বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যান। 
তার আত্মা মুক্তি পায়
একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উড়ে যায় 
যেখানে সে গাইতে পারে সত্য গান।

‘মাথা নেই তবু্ও আমি ভালোবাসি তাকে, 
মুখে গ্রহণ করা ছাড়াই ভালোবাসি সেই স্বাদ, 
ভালোবাসি সেই স্মৃতি যেখানে অনুশোচনা নেই, 
কিন্তু আমি কীভাবে হাত ছাড়াই 
এক অসীম প্রসারিত সমভূমি থেকে 
গোলাপ এবং তুলসি সংগ্রহ করি,
যা আমাকে আনন্দ দেয়।’
পানকৌড়ি তার নিজস্ব সাগরে ডুব দেয়
কর্মের কষ্ট সমস্ত দুঃখ থেকে নিরাময় করে
এবং বিশুদ্ধ সূর্যোদয় ঘটায়।
এই মসনবী যদি হঠাৎ আকাশ হয়ে যায় 
তবে এই কবি ঘুমের মধ্যে যে রহস্য উপভোগ করে
তার অর্ধেকও এই মসনবী ধারণ করতে পারবে না।
যদি এর মধ্যে প্রবেশের একটি পরিষ্কার পথ থাকত
তবে এখানে কেউ থাকত না!

এদিকে, খলিফা ওমরের কাছে
একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে–
‘কবরস্থানে ঘুমন্ত লোকটিকে 
সাতশত সোনার দিনার দান করুন।’
এই কণ্ঠস্বর সবাই বুঝতে পারে।
এই কণ্ঠস্বর একই ভাষায় একই কর্তৃত্বে
তুর্কি, কুর্দি, ফার্সি, আরব, ইথিওপিয়ানের সাথে কথা বলে! 
ওমর কবরের দিকে ছুটে যায়
কিন্তু ঘুমন্ত বৃদ্ধ ছাড়া আর কেউ নেই।
ওমর ভাবে, নিশ্চয়ই বৃদ্ধটি স্রষ্টার প্রিয় কেউ নয়!
শিকার শেষে সিংহ যেমন শিকারের চারপাশে ঘোরে
তেমনভাবে ওমর জায়গাটা ঘুরে বেড়ায়,
কিছুই খুঁজে পায় না।

লোকটি গরিব ভবঘুরে হতে পারে।
‘এই লুকানো হৃদয় একটি রহস্য!’
ওমর তার পাশে বসে কাশি দেয়।
ওমর তাকে দোষারোপ করার জন্য এসেছেন ভেবে
ভবঘুরে লোকটি লাফিয়ে উঠল। 
‘না, আপনি এখানে বসুন।
আপনাকে একটা গোপন কথা বলার আছে। 
আপনার বীণার নতুন রেশম তার কেনার জন্য  
এই বস্তায় যথেষ্ট সোনা আছে।
এটা নিন, বীণার তার কিনুন এবং এখানে ফিরে আসুন।’
বৃদ্ধ কবি তা শোনেন এবং উদারতা অনুভব করেন
যা এখন দৃশ্যমান হয়েছে। 
তিনি কাঁদলেন
তারপর বীণাটি মাটিতে ফেলে দিলেন।
বিশেষ কোনো দিনের মূল্য কেউ জানে না!

 ‘এই গানগুলো, প্রতিটি নিঃশ্বাসে
আমাকে ইরাকের বাদ্যযন্ত্র 
এবং পারস্যের ছন্দের কথা মনে করিয়ে দেয়। 
সামান্য ভিন্নতা এবং চব্বিশ ধরনের স্পষ্ট নতুনত্ব
আমাকে বিভ্রান্ত করেছে
আর সেই সময়ে কাফেলার পর কাফেলা চলে গেছে। 
আমার কবিতাগুলো আমাকে 
আমার নিজের মধ্যে রেখেছে
যা আমার জন্য তোমার দেওয়া সবচেয়ে বড়ো উপহার, 
যা আমি এখন তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। 
যখন কেউ তোমাকে দেওয়ার জন্য সোনা গোনে
তখন তার হাত বা সোনার দিকে তাকাবে না। 
দাতার দিকে তাকাও!

ওমর বলেন, ‘কিন্তু এই কান্নাকাটি আত্ম-অপরাধ,
কারাগারের আরেক আকার
এবং খাগড়ার উপর আরেকটি গিট। 
অতীতকে স্মরণ এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
তোমাকে বন্দী করবে সময়ের সিলিন্ডারে। 
সময়ের সিলিন্ডারকে ছিদ্র করো 
এবং ফাঁপা ছিদ্রযুক্ত দেয়াল হও, 
যাতে বাঁশি হয়ে বাজতে পারো।
স্রষ্টাকে প্রবাহিত হতে দাও নিজের মধ্যে। 
যার অনুসন্ধানের গুরুত্ব আবৃত থাকে
তাকে অনুসন্ধান করতে যেয়ো না। 
অনুতপ্ত হয়ে অনুতাপ করো! 

লোকটির হৃদয় জেগে ওঠে, 
এখন আর বীণার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই,
তার পশু আত্মা দূরে সরে যায়
সূচনা হয় নতুন এক আত্মার।
সত্যিকারের বিভ্রান্তিতে সে 
যেকোনো চাওয়া-পাওয়া এবং কথা বলার বাইরে চলে যায়,
মুক্তির সীমানা পেরিয়ে সৌন্দর্যে নিমজ্জিত হন
বৃদ্ধ কবিকে ঢেকে দেয় ঢেউ।
তার সম্পর্কে আর কিছু বলা যাবে না। 
সে তার পোশাক ঝাড়া দেয়, 
কিন্তু তার পোশাকের ভিতর আর কিছুই নেই। 
একটি বাজপাখি শিকার ধরার জন্য জঙ্গলে ডুব দেয় 
তারপর বাজপাখি আর ফিরে আসে না। 
প্রতি মুহূর্তে সূর্যালোক শূন্য এবং সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ। 
পুরোনো কবির মতো পৃথিবী 
প্রাণের পানিতে সতেজ হয়ে ওঠে 
এবং সূর্যের সাথে নতুন আলো উদিত হয়, 
এমন বৈচিত্র্যময়, বিচ্ছুরিত এবং সঙ্গীতময় আবহাওয়া 
ঘুম ছাড়া কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

কবিতাঃ খলিফা ওমর এবং বৃদ্ধ কবি
কবিঃ জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি 
অনুবাদঃ আলমগীর কাইজার 
(কোলম্যান বার্কসের দ্য সোল অব রুমি বই থেকে)

No comments

Powered by Blogger.