গল্পঃ মা
পুকুরপাড়। কয়েকটা তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তালগাছের নিচেই আছে কয়েকটা নিমগাছ। গাছগুলোর মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। আমি যখন অবসর পাই এখানে এসে বসে থাকি।
পুকুরের সঙ্গে লাগানো বিশাল রায়সার বিল। চুয়াডাঙ্গা জেলার কুড়ুলগাছি-চণ্ডীপুর গ্রামের কোল ঘেঁষে এই বিল। প্রতিটি বিলের একটা ইতিহাস থাকে। কীভাবে বিল সৃষ্টি হলো? কীভাবে বিলের নামকরণ করা হলো? রায়সার বিল নিয়েও এমন অনেক গল্প প্রচলিত আছে। ছোটবেলায় যখন সেসব গল্প শুনতাম, পুলকিত হতাম। এখন আর ওই সব গল্প আমাকে টানে না, তবে বিলটা প্রচণ্ডভাবে টানে।
বিলের ধারের সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করে। যার সৌন্দর্য দেখে শেষ করা যায় না, তার ইতিহাস সৌন্দর্যের কাছে গৌণ হয়ে ওঠে। বিল যখন পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয় কিংবা ধানের সময় সবুজ ধানগাছে পুরো বিল ভরে যায় তখন দুচোখে আলাদা সৌন্দর্য ধরা পড়ে।
ধানের আলপথ দিয়ে হেঁটে যেতে ভালো লাগে। আলপথে হাঁটতে গিয়ে ঘাস কিংবা ধানে লেগে থাকা পানিতে পা ভিজে যায়। মাঝে মাঝে ব্যাঙ অথবা ঢোঁড়া সাপ শব্দ করে চলে যায়। ছোটবেলায় এভাবে হঠাৎ শব্দ হলে ভয় লাগত। ছোটবেলায় ভয় পেলে বুকে থুতু দিতাম।
ছোটবেলায় সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার দেখে ভয় পেতাম, ঘর থেকে বের হতাম না। দূরের টয়লেটে প্রস্রাব করতে গিয়ে আসার সময় দৌড়ে ঘরে চলে আসতাম।
ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর মাথার ওপর চাঁদটা খুব দেখতাম। আমি যেখানেই যেতাম চাঁদটা আমার পিছু পিছু সেখানেই চলে যেত। আমি তাকিয়ে থাকতাম চাঁদের দিকে। চাঁদের ভেতর একটা বটগাছ আছে। বটগাছটা ঠিক আছে কি না, জানা নেই তবে আমি চাঁদের ভেতর একটা স্পষ্ট বটগাছ দেখতে পেতাম।
মা বলতেন, ‘ওই বটগাছের নিচে একটা বুড়ি বসে থাকে। তার একটা গাভি আছে আর একটা পানের বাটা আছে। বুড়ির দাঁত নেই, তাই বাটাতে পান বেটে পিষ্ট করে খায়।’
আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম ‘মা, বুড়ি আর কী খায়?’
মা বলতেন, ‘বুড়ি গরুর দুধ খায়।’
আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘মা, গরু কী খায়?’
মা বলতেন, ‘গরু ঘাস খায়।’
আমি বলতাম, ‘মা, গরু ঘাস কোথায় পায়।’
মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোর শ্বশুর চাঁদে গিয়ে ঘাস নিয়ে আসে।’
আমি আবার মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘আমার শ্বশুর কোথায় থাকে?’
মা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিতেন। বলতেন, ‘চল, চল, ভাত খেতে হবে। অনেক রাত হয়ে গেছে। হারিকেনের তেল ফুরিয়ে যাবে।’
আমি ভাত খেতে খেতে মাকে আবার জিজ্ঞাসা করতাম, ‘মা, আমার শ্বশুর কোথায় থাকে?’
মা ভয় দেখিয়ে বলতেন, ‘আমগাছে ভূত আছে আর প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন করলে ভূত এসে ধরে নিয়ে যাবে। চুপচাপ ভাত খেয়ে নে।’
আমি মাকে আবার প্রশ্ন করতাম, ‘চুপচাপ ভাত খেলে কি ভূতে ধরে না?’
মা বলতেন, ‘না।’
আমি একটু পর আবার মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘মা, ভূত দেখতে কেমন?’
মা এভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতেন। আমি ছোটবেলা থেকেই এভাবে প্রশ্ন করতে থাকি। শুধু আমার মাকে না, সবাইকেই প্রশ্ন করতে থাকি। কেউ কেউ আমার প্রশ্ন শুনে খুবই বিব্রত হন, কেউ কেউ আমাকে অপছন্দ করেন।
আমি প্রশ্ন করে যাই প্রতিনিয়ত। আমি আমার আশপাশের মানুষগুলোকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলি। আমার মা ব্যতীত আমার প্রশ্নগুলো কেউই সহ্য করতে পারে না। আমার মা-ই একমাত্র মানুষ, যিনি আমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ধৈর্যসহকারে দিতেন। আমার মা আমার প্রতিটি প্রশ্নকে মূল্যায়ন করতেন। আমার প্রশ্নে তিনি হয়তো বিরক্ত হতেন কিন্তু কখনো নিষেধ করতেন না।
আমি বসে আছি পুকুরপাড়ে। হঠাৎ নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাই। পেছনে ফিরে দেখি বেগুনি রঙের শাড়ি পরা অপরিচিত একটি মেয়ে। অসম্ভব সুন্দর মেয়েটির শাড়ির আঁচলের শেষপ্রান্ত পুকুরপাড়ের ঘাসের ওপর পড়ে আছে। মেয়েটির কপালে কালো টিপ, হাতে নানা রঙের মিশ্রিত কাচের চুড়ি। প্রশস্ত কপালে স্পষ্ট ভালোবাসার চিহ্ন। সে আমাকে মৃদু স্বরে বলল, ‘একা একা কী করো? বাড়ি যাও, আম্মু ডাকছে।’ আমি তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু কোনো উত্তর দিলাম না।
বসে আছি। হঠাৎ খুব শব্দ করে তালগাছ থেকে তালের শুকনো পাতাসহ একটি ডগা পড়ল। আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আর আমার পেছনে নেই। অনেক দূরে চলে গেছে।
© আলমগীর কাইজার
গল্পটি প্রথম আলো অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত। লিংক এখানে ক্লিক করুন
পুকুরের সঙ্গে লাগানো বিশাল রায়সার বিল। চুয়াডাঙ্গা জেলার কুড়ুলগাছি-চণ্ডীপুর গ্রামের কোল ঘেঁষে এই বিল। প্রতিটি বিলের একটা ইতিহাস থাকে। কীভাবে বিল সৃষ্টি হলো? কীভাবে বিলের নামকরণ করা হলো? রায়সার বিল নিয়েও এমন অনেক গল্প প্রচলিত আছে। ছোটবেলায় যখন সেসব গল্প শুনতাম, পুলকিত হতাম। এখন আর ওই সব গল্প আমাকে টানে না, তবে বিলটা প্রচণ্ডভাবে টানে।
বিলের ধারের সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করে। যার সৌন্দর্য দেখে শেষ করা যায় না, তার ইতিহাস সৌন্দর্যের কাছে গৌণ হয়ে ওঠে। বিল যখন পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয় কিংবা ধানের সময় সবুজ ধানগাছে পুরো বিল ভরে যায় তখন দুচোখে আলাদা সৌন্দর্য ধরা পড়ে।
ধানের আলপথ দিয়ে হেঁটে যেতে ভালো লাগে। আলপথে হাঁটতে গিয়ে ঘাস কিংবা ধানে লেগে থাকা পানিতে পা ভিজে যায়। মাঝে মাঝে ব্যাঙ অথবা ঢোঁড়া সাপ শব্দ করে চলে যায়। ছোটবেলায় এভাবে হঠাৎ শব্দ হলে ভয় লাগত। ছোটবেলায় ভয় পেলে বুকে থুতু দিতাম।
ছোটবেলায় সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার দেখে ভয় পেতাম, ঘর থেকে বের হতাম না। দূরের টয়লেটে প্রস্রাব করতে গিয়ে আসার সময় দৌড়ে ঘরে চলে আসতাম।
ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর মাথার ওপর চাঁদটা খুব দেখতাম। আমি যেখানেই যেতাম চাঁদটা আমার পিছু পিছু সেখানেই চলে যেত। আমি তাকিয়ে থাকতাম চাঁদের দিকে। চাঁদের ভেতর একটা বটগাছ আছে। বটগাছটা ঠিক আছে কি না, জানা নেই তবে আমি চাঁদের ভেতর একটা স্পষ্ট বটগাছ দেখতে পেতাম।
মা বলতেন, ‘ওই বটগাছের নিচে একটা বুড়ি বসে থাকে। তার একটা গাভি আছে আর একটা পানের বাটা আছে। বুড়ির দাঁত নেই, তাই বাটাতে পান বেটে পিষ্ট করে খায়।’
আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম ‘মা, বুড়ি আর কী খায়?’
মা বলতেন, ‘বুড়ি গরুর দুধ খায়।’
আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘মা, গরু কী খায়?’
মা বলতেন, ‘গরু ঘাস খায়।’
আমি বলতাম, ‘মা, গরু ঘাস কোথায় পায়।’
মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোর শ্বশুর চাঁদে গিয়ে ঘাস নিয়ে আসে।’
আমি আবার মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘আমার শ্বশুর কোথায় থাকে?’
মা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিতেন। বলতেন, ‘চল, চল, ভাত খেতে হবে। অনেক রাত হয়ে গেছে। হারিকেনের তেল ফুরিয়ে যাবে।’
আমি ভাত খেতে খেতে মাকে আবার জিজ্ঞাসা করতাম, ‘মা, আমার শ্বশুর কোথায় থাকে?’
মা ভয় দেখিয়ে বলতেন, ‘আমগাছে ভূত আছে আর প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন করলে ভূত এসে ধরে নিয়ে যাবে। চুপচাপ ভাত খেয়ে নে।’
আমি মাকে আবার প্রশ্ন করতাম, ‘চুপচাপ ভাত খেলে কি ভূতে ধরে না?’
মা বলতেন, ‘না।’
আমি একটু পর আবার মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘মা, ভূত দেখতে কেমন?’
| মা |
আমি প্রশ্ন করে যাই প্রতিনিয়ত। আমি আমার আশপাশের মানুষগুলোকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলি। আমার মা ব্যতীত আমার প্রশ্নগুলো কেউই সহ্য করতে পারে না। আমার মা-ই একমাত্র মানুষ, যিনি আমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ধৈর্যসহকারে দিতেন। আমার মা আমার প্রতিটি প্রশ্নকে মূল্যায়ন করতেন। আমার প্রশ্নে তিনি হয়তো বিরক্ত হতেন কিন্তু কখনো নিষেধ করতেন না।
আমি বসে আছি পুকুরপাড়ে। হঠাৎ নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাই। পেছনে ফিরে দেখি বেগুনি রঙের শাড়ি পরা অপরিচিত একটি মেয়ে। অসম্ভব সুন্দর মেয়েটির শাড়ির আঁচলের শেষপ্রান্ত পুকুরপাড়ের ঘাসের ওপর পড়ে আছে। মেয়েটির কপালে কালো টিপ, হাতে নানা রঙের মিশ্রিত কাচের চুড়ি। প্রশস্ত কপালে স্পষ্ট ভালোবাসার চিহ্ন। সে আমাকে মৃদু স্বরে বলল, ‘একা একা কী করো? বাড়ি যাও, আম্মু ডাকছে।’ আমি তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু কোনো উত্তর দিলাম না।
বসে আছি। হঠাৎ খুব শব্দ করে তালগাছ থেকে তালের শুকনো পাতাসহ একটি ডগা পড়ল। আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আর আমার পেছনে নেই। অনেক দূরে চলে গেছে।
© আলমগীর কাইজার
গল্পটি প্রথম আলো অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত। লিংক এখানে ক্লিক করুন

No comments