হবুচন্দ্রের আইন ( কবিতা)

হবুচন্দ্রের আইন
- সুনির্মল বসু  
 
হবুচন্দ্র রাজা বলেন, গবুচন্দ্রে ডেকে-- 
'আইন জারি করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে, 
মোর রাজ্যের ভিতর 
হোকনা গরীব, ভদ্র কিম্বা ইতর, 
কাঁদতে কেহ পারবেনা'ক, যতই মরুক শোকে, 
হাসবে আমার যতেক প্রজা, হাসবে যত লোকে। 
শান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা-পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে, 
কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে।' 

বল্লে গবু-- 'হুজুর,-- 
ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈত্য, দানা, জুজুর, 
কিম্বা যদি পিছলে প'ড়ে মুন্ডু ফাটায় কেহ, 
গাড়ীর তলে কারুর যদি থেঁতলিয়ে যায় দেহ, 
কিম্বা যদি কোনো প্রজার কান দুটি যায় কাটা, 
কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের উপর ঝাঁটা, 
সত্যিকারের বিপন্ন হয়ে যদি, 
তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি?' 

রাজা বলেন,---'গবু, 
আমার আইন সকল প্রজার 
মানতে হবে তবু। 
কেউ যদি হয় খুন বা জখম, 
হাড্ডিতে ঘুণ ধরে, 
পাজঁরা যদি ঝাঁঝরা হয়ে 
মজ্জা ঝ'রে পড়ে, 
ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে, 
ভুঁরিটি যায় ফেঁসে, 
অন্ধকারে স্কন্ধকাটা 
ঘাড়টি ধরে ঠেসে, 
কিম্বা যদি ধড়ের থেকে 
মুন্ডুটি যায় উড়ে, 
কাঁদতে কেহ পারবে নাক বিশ্রী বিকট সুরে। 
হবু চন্দ্রের দেশে--- 
মরতে যদি হয় কখনো, নরতে হবে হেসে।' 

পিটিয়ে দিল ঢ্যাঁড়া গবু রাজার আদেশ পেয়ে-- 
'কাঁদতে কেহ পারবেনা আর, পুরুষ কিম্বা মেয়ে, 
যতই শোকের কারণ ঘটুক, হাসতে হবে তবু, 
আদেশ দিলেন রাজাধিরাজ হবু, 
রাজার আদেশ কেউ যদি যায় ভুলে, 
চড়তে হবে শূলে।' 

সেদিন হতে হবুর দেশে 
উল্টে গেল রীতি, 
হররা-হাসির হট্রগোলে, 
অট্র-হাসির অট্ররোলে, 
জাগলো তুফান নিতি। 
হাসির যেন ঝড় বয়ে যায় 
রাজ্যখানি জুড়ে, 
সবাই হাসে যখন তখন 
প্রাণ-কাঁপানো সুরে। 

প্যায়দা-পাইক ছদ্মবেশে হদ্দ অবিরত, 
কান্না কারো শুনতে না পায়, হাঁপায় রীতিমত। 
সবাই হাসে আশে-পাশে, 
বিষম খেয়ে ভীষণ হাসে, 
আস্তাবলে সহিস হাসে, আস্তাকুঁড়ে মেথর, 
হাসছে যত মুমূর্ষুরা হাসপাতালের ভেতর। 
আইন জেনে সর্ব্বনেশ 
ঘাটের মড়া উঠছে হেসে, 

বেতো-রোগী দেঁতো-হাসি হাসছে বসে ঘরে! 
কাশতে গিয়ে কেশো বুড়ো হাসতে সুরু করে। 
হাসছে দেশের ন্যাংলাফ্যাচাং হ্যাংলো-হাঁদা যত, 
গোমরা-উদো-নোংরা-ডোঁপো-চ্যাংড়া শত শত, 
কেউ কাঁদে না কান্না পেলেও, 
কেউ কাঁদে না গাঁট্রা খেলেও, 
পাঠশালাতে বেত্র খেয়ে ছাত্রদলে হাসে, 
কান্না ভুলে শিশুর দলে হাসছে অনায়াসে। 

রাজা হবু বলেন আবার গবচন্দ্রে ডাকি, 
'আমার আইন মেনে সবাই 
আমায় দিল ফাঁকি! 
রাজ্যে আমার খাঁদার কথা 
সবাই গেল ভুলে, 
কেউ গেলনা শূলে? 
একটা লোকও পেলামনা এইবারে 
শূলে চড়াই যারে। 
নিয়ম আমার কড়া 
প্রতিদিনই একটি লোকের 
শূলেতে চাই চড়া। 
যা হোক, আজই সাঁঝের আগে 
শূলে দেবার তরে--- 
যে করে হোক একটি মানুষ আনতে হবে ধরে।' 

গবুচন্দ্র বল্লে হেসে 
চেয়ে রাজার মুখে, 
'কাঁদতে পারে এমন মানুষ 
নাই যে এ মুলুকে 
আমি না হয় নিজেই কেঁদে 
আইন ভেঙে তবে 
চড়ব শূলে, মহারাজের 
নিয়ম রক্ষা হবে 
কিন্তু একি, আমিও যে 
কাঁদতে গেছি ভুলে 
কেমন করে চড়ব তবে শূলে?' 

রাজা বলেন, 'তোমার মত মূর্খ দেখি নাযে, 
কাঁদতে তুমি ভুলে গেছ এই ক'দিনের মাঝে? 
এই দ্যাখোনা কাঁদে কেমন করে'--- 
এই না বলে হবু রাজা কেঁদে ফেললেন জোরে। 

মন্ত্রী গবু বল্লে তখন, 'এবার তবে রাজা--- 
নিজের আইন পালন করুন, গ্রহণ করুন সাজা।' 

বলেন হবু, 'আমার হুকুম নড়বে না এক চুল, 
আমার সাজা আমিই নেব, তৈরি কর শূল।' 


সুনির্মল বসু

No comments

Powered by Blogger.